আলেমগণ কি নবীদের পক্ষ থেকে কেবল দ্বীনের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী না কি দুনিয়াবী (বিজ্ঞান, মেডিসিন ইত্যাদি) জ্ঞানেরও উত্তরাধিকারী?



 আলেমগণ কি নবীদের পক্ষ থেকে কেবল দ্বীনের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী না কি দুনিয়াবী (বিজ্ঞান, মেডিসিন ইত্যাদি) জ্ঞানেরও উত্তরাধিকারী?


প্রশ্ন: রাসূল (সাঃ) যে বলেছেন, "আলেমরা নবীদের উত্তরসুরি"-এ হাদিসটির ব্যাখ্যা জানতে চাই। এ হাদিস দ্বারা কি শুধু দ্বীনের আলেমকে বুঝায় নাকি অন্য বিষয়ের আলেমকেও বুঝায়? যেমন বিজ্ঞান, মেডিসিন ইত্যাদির আলেম?


উত্তর:

প্রথমে আমরা "আলেমরা নবীদের উত্তরসুরি" এ সংক্রান্ত পূর্ণ হাদীসটি দেখব। তারপর এ সংশ্লিষ্ট আরও কতিপয় আয়াত ও হাদীস তুলে ধরে মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যার আলোকে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।


পূর্ণ হাদীসটি নিম্নরূপ:


রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ، وَمَنْ فِي الْأَرْضِ، وَالْحِيتَانُ فِي جَوْفِ الْمَاءِ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ، كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا، وَلَا دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ

“যে (আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে] ইলম তথা জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন।ফেরেশতাগণ ইলম অন্বেষণকারীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার পায়ের নিচে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। একজন ইলম অন্বেষণ কারীর জন্য আসমান জমিনে যা কিছু আছে সবাই ক্ষমা প্রার্থনা ও দুয়া করে; এমনকি পানির মধ্যকার মাছও।

আর একজন আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ আবেদ (ইবাদতকারী) এর তুলনায় পূর্ণিমা রাতে সমস্ত নক্ষত্ররাজির তুলনায় চাঁদের মত। আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরী। নবীগণ উত্তরাধিকারী সম্পদ হিসেবে দিনার-দিরহাম তথা অর্থ-সম্পদ রেখে যান না বরং তারা  উত্তরাধিকারী সম্পদ হিসেবে রেখে গেছেন ইলম। যে সেটাকে গ্রহণ করল সে যেন পুর্ণ অংশকেই গ্রহণ করল।” (তিরমীজি-২৬৮২,আবু দাউদ-৩৬৪১, ইবনে মাজাহ-২২৩, মুসনাদে ইবনে আবি শায়বা-৪৭, মুসনাদে আহমাদ- ২১৭১৫)


ব্যাখ্যা: 


নবীদের দায়িত্ব ছিল, আল্লাহর পক্ষ অবর্তীণ ওহীর জ্ঞানকে মানুষের মাঝে প্রচার করা। ওলামাগণ সেই ওহীর জ্ঞানেরই ধারক ও বাহক। এই দৃষ্টিতে তাদেরকে নবীদের উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে।


আলেমগণ নবীদের রেখে যাওয়া দ্বীন বা শরীয়ের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী:


উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায়, আলেমগণ নবীদের রেখে যাওয়া দ্বীন বা শরীয়তের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী; সাধারণ দুনিয়াবী জ্ঞানের নয়। তাদের দায়িত্ব নবীদের সেই ইলমে শরীয়তকে মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া।

 

🔹আলেমদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:

 إِنَّمَا يَخْشَى اللَّـهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ۗ

“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই (যারা দ্বীনী বিষয়ে জ্ঞানী) কেবল তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির: ২৮)

মুফাসসিরগণ এর ব্যাখ্যায় বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে যত বেশী জ্ঞানার্জন করবে সে তত বেশি তাঁকে ভয় করবে। আর যে  যত বেশি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে পারবে, সে তত বেশি তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করে ধন্য হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ

“আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। এটা (পূর্বোল্লিখিত পুরস্কার) তার জন্য যে তার রবকে ভয় করেছে।” (সূরা আল বায়্যেনাহ: ৮)


🔹 জ্ঞানের সাথে আল্লাহভীতির সম্পর্ক রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

إِنَّ أَتْقَاكُمْ وَأَعْلَمَكُمْ بِاللَّهِ أَنَا

“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক তাক্বওয়া সম্পন্ন এবং আল্লাহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী হলাম আমি। ” (সহীহুল বুখারী)


🔷 দ্বীনের জ্ঞান সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:

مَنْ يُرِدْ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ

“আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।” [বুখারী(৩১১৬)]


উপরোক্ত আয়াত, হাদিস ও আলেমদের বক্তব্যের আলোকে প্রতিভাত হল যে, নবীগণ ওহীর জ্ঞান বিতরণ করেছেন এবং তা উত্তরাধিকার সম্পদ হিসেবে রেখে গেছেন। আর যুগ পরম্পরায় সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, মুজতাহিদ ইমাম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং ফকিহগণ সকলেই ছিলেন সেই ইলমে ওয়াহী তথা শরীয়তের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।

তবে আল্লাহ তাআলা মানুষকে দুনিয়া পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেছেন। সে আলোকে তারা মেডিকেল, সাইন্স, টেকনোলোজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করে, আল্লাহর সৃষ্টি বৈচিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে, মানব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করে এবং দুনিয়াবি উপকারে সেগুলো কাজে লাগায়। এগুলো মানুষ সময়ের প্রয়োজনেই করে। ইসলাম মানুষকে এ সব দুনিয়াবি উপকারী বিষয়ে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, সৃষ্টি জগতের রহস্য উন্মোচন, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারকে বাধা দেয় না বরং এসবের প্রতি উৎসাহিত করে কিন্তু তা হতে হবে বিশ্বচরাচরের একচ্ছত্র সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি মহান আল্লাহর বিধিবিধান মেনে; তার বিরুদ্ধাচরণ করে নয়।


তাহলে মানুষ দুনিয়াতে যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ জীবনের অধিকারী হবে তমনি আখেরাতেও পাবে অনন্ত চিরসুখের নীড় জান্নাত।


 আল্লাহ তাওফিক দান করুন, আমীন।


উত্তর প্রদানে:

আব্দল্লাহিল হাদী আব্দুল জলীল মাদানী

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব


আমি অবশেষে একটি কথা বলে নিতে চাই তা হলো, আমিও আপনাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ তাই আমারও ভুল থাকতে পারে। তাই আমার লেখায় যদি কোথাও কোনো ভুল পান, হোক সেটা বানান ভুল কিংবা আমার কথা বা মতবাদে কোনো ভুল তাহলে সেটা দয়া করে ক্ষমার চোখে দেখবেন এবং আমার সেই ভুলটাকে ধরিয়ে দিবেন যেনো আমি পরবর্তীতে ভুলটা শুধরে নিতে পারি।

No comments

Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.